চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান কি অনিবার্য ছিল?
- আপলোড সময় : ০১-০১-২০২৫ ০১:১১:৩৪ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ০১-০১-২০২৫ ০১:১১:৩৪ পূর্বাহ্ন
মোঃ শাহাদত হোসেন
অসাধারণ এক গণঅভ্যুত্থান হয়ে গেল ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে। জুলাই-আগস্টের এ অভ্যুত্থান শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর ইতিহাসে সোনালী অক্ষরে লেখা থাকবে। মূলত স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দেশের জনগণকে সাথে নিয়ে কিভাবে একটি দেশের প্রশাসন-বিচারালয়-পুলিশ-বিজিবি-সেনাবাহিনী-রাজনৈতিক দলের নিপীড়নের তোয়াক্কা না করে স্বৈরশাসনের অবসান ঘটাতে পারে সে দৃষ্টান্তই স্থাপন করেছে তারা। তাদের এ লড়াই তাই যুগে যুগে মজলুম মানুষকে অনুপ্রাণিত করবে।
বাংলাদেশের মানুষ যখন নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলো, স্বৈরশাসনকে আর হটানো সম্ভব নয় এবং বিরোধীদলীয় অনেক রাজনৈতিক নেতা-কর্মী যখন স্বৈরতন্ত্রের পদতলে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হলো, ঠিক তখন ছোট্ট একটি কোটাবিরোধী আন্দোলন অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মত সারাদেশে ছড়িয়ে পড়লো। কোটা সংস্কারের দাবি হয়ে গেলো আট দফা, তারপর সব দফা একদফাতে মিলিত হয়ে মহাশক্তিতে অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালো। মহাশক্তিকে মোকাবেলা করার শক্তি বা সাহস পৃথিবীর কোন প্রশাসন-বিচারালয়-পুলিশ-বিজিবি-সেনাবাহিনী-রাজনৈতিক দলের নেই। তাই মহাশক্তির মহাপ্লাবনে লৌহমানবীখ্যাত শেখ হাসিনার সরকার খড়কুটোর মতো ভেসে গেলো। যে জগদ্দল পাথরকে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামি বা অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলো দীর্ঘ ষোলো বছর চেষ্টা করেও এক চুলও নাড়াতে পারেনি, সেই সহ¯্রটনী জগদ্দল পাথর ছাত্র-জনতার মহাসমুদ্রের মহা ঢেউয়ে নিমিষে ধুলোর সাথে মিশে গেলো।
পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক স্বৈরশাসনের পতন ঘটেছে। কিন্তু এমন করুণ ও হৃদয়বিদারক পতনের ঘটনা খুব একটা নেই। তারুণ্যের অগ্ন্যুৎপাতে ভীত হয়ে দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তিই (প্রধানমন্ত্রী) শুধু নন, পালিয়ে গেছেন তার মন্ত্রিসভার অর্ধশতাধিক মন্ত্রী। শুধু তাই নয়, একটি দেশের জাতীয় সংসদের তিনশত জন সদস্যের পালিয়ে যাওয়ার নজিরও পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। এমনকি নিজেদের অপকর্মের বিচারের আশঙ্কায় ভীত হয়ে পালিয়ে গেছে অনেক সচিব, পুলিশ, সাংবাদিক, আইনজীবী, ব্যবসায়ী, মেয়র, চেয়ারম্যান, শিল্পী, লেখক, সাবেক বিচারক, রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীরা। এ যেন পালানোর মচ্ছব লেগেছে।
আর এ পালানোর মচ্ছব দেখেই বুঝা যায়, বিগত ষোলো বছরে দেশে কী পরিমাণ দুর্নীতি হয়েছে। গণতন্ত্রের বাতাবরণে এত মানুষ হত্যা, খুন, গুমের ঘটনা বিরল। একটি দুটি নয়, নিদেনপক্ষে আটটি আয়নাঘর তৈরি করা হয়েছিলো মানুষকে নির্যাতন করার জন্যে। নির্যাতন করেও যাদেরকে ‘পথে’ আনতে পারতো না, তাদেরকে ভ্যানিশ করে দেয়া হতো। কী নির্মম!
২০১৪, ২০১৯ ও ২০২৪ সালে হয়েছে প্রহসনের নির্বাচন। বশংবদ নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে একেবারে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছিলো। তার চেয়েও বড় কথা, ২০১৪ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে ভারত সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছিলো। ভারতের নগ্ন হস্তক্ষেপের ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র বিপন্ন হয়ে পড়ে। অরেক স্বৈরাচার এরশাদের জাতীয় পার্টি ছিলো অওয়ামী লীগ ও ভারতের ট্রা¤প কার্ড। জনবিচ্ছিন্ন ও জনধিকৃত জাতীয় পার্টিকে যথেচ্ছ ব্যবহার করেছে ভারত ও আওয়ামী লীগ।
বিগত স্বৈরশাসনের প্রথম দোসর হলো বিচার বিভাগ। সাবেক বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক বেআইনি একটি রায় দিয়ে দেশকে অরাজকতার দিকে ঠেলে দেন। নিঃসন্দেহে তাঁর সেই রায় দেশে স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠায় বড় ভূমিকা রেখেছে। অধস্তন বিচারকরাতো বটেই, উচ্চ আদালতের বিচারকরাও ফরমায়েশি রায়ে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। বিরোধী মত ও দলের লোকদেরকে বিচারকরা ন্যায়বিচার প্রাপ্তির পরিবর্তে বেআইনিভাবে জেল ও রিমান্ড দিতো।
স্বৈরশাসনকে প্রলম্বিত করার জন্য অনুগত একটি সাংবাদিক শ্রেণি তৈরি করা হয়েছিলো। তারা হাজারো মিথ্যা বুলির মাধ্যমে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছে। এসব সাংবাদিকেরা উন্নয়নের দোহাই দিয়ে শাসকগোষ্ঠীর সকল অপকর্মকে সমর্থন দিতো। এমন একটা অবস্থা হয়েছিলো যে, বাংলাদেশের মানুষ সাহেব-বিবি-গোলামের বাক্সতো দূরের কথা বেসরকারি কোন টিভি চ্যানেলও দেখতোনা। দুয়েকটি ব্যতিক্রম বাদে পড়তোনা কোন পত্রিকা। ফলে মূলধারার মিডিয়ার বাইরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম শক্তিশালী হয়ে ওঠে, যা আন্দোলনে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছিলো।
দেশের পুলিশ আর সরকারের ছাত্র সংগঠন এক হয়ে গিয়েছিলো। বাংলাদেশ পুলিশের ‘পুলিশ’ আর ছাত্রলীগের ‘লীগ’ নিয়ে নতুন বাহিনী গড়ে ওঠেছিলো যার নাম পুলিশ-লীগ। এই পুলিশলীগ জনগণের সকল সভা-সমাবেশ ও আন্দোলনে নির্বিচারে নির্যাতন চালায়। খুন, হত্যা ও নির্যাতনের অঘোষিত লাইসেন্স ছিলো তাদের হাতে। হিটলারের গেস্টাপো বাহিনীকেও হার মানিয়েছিলো এই পুলিশলীগ।
দেশে স্বৈরশাসন এমনভাবে চেপে বসেছিলো যে কোন রাজনৈতিক দলই স্বাধীনভাবে কোন কর্মসূচি পালত করতে পারতো না। কোন সামাজিক সংগঠন এমন কোন সমাবেশ করতে পারতো না, যা সরকারের বিরুদ্ধে যায়। সাধারণ শিক্ষার্থীরা পর্যন্ত কোন দাবি-দাওয়া পেশ করতে পারতো না। ছিলো না নিরাপদ সড়কের অধিকার।
সর্বোপরি দেশে একটি অনুগত সুশীল সমাজ গড়ে ওঠেছিলো। তাদের কাজই ছিলো জনগণের প্রত্যাশার বিপরীতে শাসকগোষ্ঠীর বন্দনা ও উন্নয়নের ফিরিস্তি প্রকাশ করা। অনেক শিক্ষক, লেখক, সাহিত্যিক, শিল্পী, সাংবাদিক, অভিনেতা, নাট্যকর্মী, বুদ্ধিজীবী, মুক্তিযোদ্ধা বিবেক বন্ধক দিয়েছিলো অর্থমোহের কাছে। এরকম পরিস্থিতিতে পুরো জাতি যখন হতাশায় নিমজ্জিত, তখনই ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হয় কোটাবিরোধী আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা। কোটার সংস্কার থেকে বৈষম্যরোধের প্রত্যয় শেষ হয় একদফাতে, স্বৈরাচারের পদত্যাগে। ৩৬ জুলাই সাফল্য নিয়েই ঘরে ফিরে ছাত্র-জনতা।
নিঃসন্দেহে বাংলাদেশে জুলাই বিপ্লব অনিবার্য ছিল। অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি সত্ত্বেও একথা অনস্বীকার্য যে, বাংলাদেশের মানুষ প্রচ- রকমের স্বাধীনতাপ্রিয়। ফলে ১৯৪৭ সালে নিজেদের গড়া পাকিস্তানকে ২৪ বছরের মাথায় ছুড়ে ফেলে দিয়ে রক্তক্ষয়ী এক মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একনায়কতন্ত্র (বাকশাল) প্রতিষ্ঠা করলে পরের বছর অর্থাৎ ১৯৭৫ সালেই তাঁকে ক্ষমতার সাথে সাথে পৃথিবী থেকেও নির্মমভাবে বিদায় নিতে হয়। সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বাধীনতার পর পুনরায় স্বাধীনতা ফিরে পায় বাংলাদেশ।
দ্রুতই রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয়ে জন্ম হয় স্বৈরাচার এরশাদের। শুরু হয় বাংলাদেশিদের স্বাধীনতার লড়াই, স্বৈরাচার থেকে মুক্তির লড়াই। অনেক আত্মত্যাগের বিনিময়ে ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদকে বিদায় করতে সক্ষম হয় ছাত্র-জনতা। দেশবাসী ধরেই নিয়েছিলো এদেশ থেকে চিরদিনের মত স্বৈরাচার বিদায় নিয়েছে। মানুষ ভেবেছিলো, দেশের মানুষকে আর কোনদিন স্বাধীনতার জন্য রক্ত দিতে হবে না। কিন্তু ভুল। অচিরেই বাংলাদেশের ভাগ্যাকাশ থেকে গণতন্ত্র বিদায় নেয়। স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী দলটি নিজেরাই স্বৈরাচারের তকমা গায়ে মাখে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সুবিধা নিয়ে অতীতের সকল স্বৈরশাসনকে লজ্জায় ফেলে দানবীয় হয়ে ওঠে দলটি এবং দলের নেতা-কর্মীরা। ২০০৮ সালের পর ২০১৪ সাল থেকে স্বৈরশাসন পাকাপোক্ত হলে দেশে আবারো শুরু হয় গণতন্ত্র উদ্ধারের লড়াই। দীর্ঘ ১০ বছরের সংগ্রাম শেষে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টে পুনরায় স্বাধীনতা ফিরে পায় বাংলাদেশ। দশ বছরের সংগ্রাম-লড়াই হলেও ২০২৪ সালের জুনে কোটা বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়, যা জুলাই মাসে পরিপূর্ণতা লাভ করে। সাফল্য আসে ৫ আগস্টে, জেন-জি’দের ভাষায় ৩৬ জুলাইয়ে।
এখন কথা হলো, বাংলাদেশের মানুষ আর কতবার গণতন্ত্রের জন্য রক্ত দিবে? আর কতবার তারা স্বাধীনতার জন্য লড়াই করবে? ১৯৭১, ১৯৭৫ ও ১৯৯০ তাদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন করতে পারেনি। ২০২৪ কি তা পারবে? সময়েই সেটা বলে দিবে। তবে মানুষের প্রত্যাশা হলো, দেশের ছাত্র-জনতাকে যেন আর রক্ত দিতে না হয়। তাই দেশবাসী এখন সংস্কার চাইছে। এমন একটা সিস্টেম চাইছে, যেন কেউ চাইলেও স্বৈরশাসকে পরিণত হতে না পারে। ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থান ও সংস্কারের এটিই স্বপ্ন।
[লেখক- মোঃ শাহাদত হোসেন, সহকারী অধ্যাপক, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, গুরুদয়াল সরকারি কলেজ, কিশোরগঞ্জ]
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ